ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তঘেঁষা সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায় সুরমা নদীর তীরে ১৯৩৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ছাতক সিমেন্ট কারখানা। বর্তমানে এটি শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) একটি প্রতিষ্ঠান।
কারখানার উৎপাদন বাড়াতে উৎপাদন পদ্ধতি ওয়েট প্রসেস থেকে ড্রাই প্রসেসে রূপান্তরকরণে ২০১৬ সালে ৬৬৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয় বিসিআইসি। সেই খরচ বাড়িয়ে ৮৯০ কোটি টাকা করা হয়। সর্বশেষ গত ৯ মে খরচ বাড়িয়ে এক হাজার ৪১৭ কোটি টাকা করা হয়। এতে বেড়েছে প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ।
বিদ্যমান পুরোনো, অপেক্ষাকৃত কম উৎপাদনক্ষম ওয়েট প্রসেস পদ্ধতির পরিবর্তে ড্রাই প্রসেসের দৈনিক দেড় হাজার মেট্রিক টন (বছরে সাড়ে চার লাখ মেট্রিক টন) উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি নতুন জ্বালানি সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ক্লিংকার ফ্যাক্টরি স্থাপন এবং বিদ্যমান সিমেন্ট ফ্যাক্টরির উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ৫০০ টন ন্যূনতম ১৫ বছর ধরে রাখার লক্ষ্যে এ প্রকল্প নেওয়া হয়।
প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৫৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ, বান্তব অগ্রগতি ৯০ দশমিক ৭০ শতাংশ। প্রকল্পের ভারতের অংশের রোপওয়ে ছাড়া কারখানার অন্য সব প্ল্যান্টের নির্মাণ ও এক হাজার ৪১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটি ইতোমধ্যে প্রায় ৯০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে।
তবে রোপওয়ে (রজ্জুপথ) নির্মাণ ও নতুন গ্যাসলাইন স্থাপন শেষ না হওয়ায় এ প্রকল্প কাজের মেয়াদ আরোও ১ বছর বাড়ানোর প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে নিশ্চিত করেছে।
আরও পড়ুন: জৈন্তাপুরে তরমুজের বাম্পার ফলন, সেচ-পরিবহন সমস্যায় কৃষকরা
সুনামগঞ্জে এক হাজার ৪১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বান্তবায়িত হচ্ছে ‘ছাতক সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের উৎপাদন পদ্ধতি ওয়েট প্রসেস থেকে ড্রাই প্রসেসে রূপান্তরকরণ (দ্বিতীয় সংশোধিত)’ প্রকল্প। চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মোট ব্যয় হয় ৮৩১ কোটি ৮৮ লাখ ৩০ হাজার টাকা। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এই কারখানার নির্মাণকাজ প্রায় দেড় বছর আগে শেষ হয়েছে। কিন্তু প্রধান কাঁচামাল গ্যাস ও চুনাপাথরের অভাবে চালু করা যাচ্ছে না রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কারখানাটি। ভারত থেকে চুনাপাথর আনার জন্য দুই দেশে রোপওয়ে (খুঁটি পুঁতে তারের মাধ্যমে পথ তৈরি করে চুনাপাথর আনার পদ্ধতি) নির্মাণ করা হয়নি। এমনকি সিলেট থেকে কারখানা পর্যন্ত গ্যাস আনার জন্য নতুন সঞ্চালন লাইনও স্থাপন করা হয়নি। ফলে ধীরে ধীরে জং ধরছে হাজার কোটি টাকার ছাতক সিমেন্ট কারখানায়। জং ধরা থেকে কারখানাকে রক্ষা করতে নিয়মিত ‘ট্রায়াল রান’ দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভারতের মেঘালয় রাজ্যে অবস্থিত কোমোরাহ লাইমস্টোন মাইনিং কোম্পানি (কেএলএমসি) থেকে রোপওয়ের মাধ্যমে চুনাপাথর আমদানি করত ছাতক সিমেন্ট কোম্পানি। এই রোপওয়ের ১১ কিলোমিটার অংশ পড়েছে বাংলাদেশে। ভারতে পড়েছে পাঁচ কিলোমিটারের একটু বেশি। ছাতক সিমেন্টের নতুন কারখানার জন্য যে পরিমাণ চুনাপাথর প্রয়োজন হবে, তা আগের রোপওয়ে দিয়ে আনা সম্ভব নয়। আবার বাংলাদেশ অংশের রোপওয়ে এরই মধ্যে ভেঙে বিক্রিও করে দেওয়া হয়। নতুন করে রোপওয়ে নির্মাণের বিষয়টি প্রকল্পে থাকলেও ভারতের অনুমতি না পাওয়ায় সেটির কাজও এখনো শুরু হয়নি।
এদিকে, ২০২০ সালের মার্চে করোনাভাইরাস মহামারির সময় ভারত চুনাপাথর রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলে কারখানাটি কাঁচামালের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও ভারত সরকার কেএলএমসির নিবন্ধন নবায়ন না করায় প্রতিষ্ঠানটি থেকে চুনাপাথর আসা বন্ধ থাকে। যদিও এই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত চুনাপাথর আমদানির চুক্তি ছিল ছাতক সিমেন্ট কারখানার। এখন আমদানির বিষয়টি নির্ভর করছে কেএলএমসির অনুমোদন পাওয়ার ওপর।
আরও পড়ুন: রাজধানীর বস্তিগুলোতে নেশার ছোবল
গত ৮ ডিসেম্বরের এক সভায় প্রকল্প পরিচালক জানান, কেএলএমসির মাইনিং অনুমোদন এবং ভারতীয় অংশে রোপওয়ে মেরামত/প্রতিস্থাপনের অনুমোদন না পাওয়ার কারণে রোপওয়ের কাজের জন্য প্রকল্প বিলম্বিত করা হচ্ছে। কেএলএমসি থেকে ছাতক সিমেন্ট কারখানা পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার রোপওয়ের মধ্যে চার দশমিক ছয় কিলোমিটার পড়েছে ভারতীয় অংশে। উভয় অংশের ১৭ কিলোমিটার রোপওয়ে নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছে সাধারণ ঠিকাদার চীনের নানজিং সি-হোপ সিমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি। তবে ভারতীয় অংশে ৪ দশমিক ৬ কিলোমিটার রোপওয়ে স্থাপনের কাজ সাধারণ ঠিকাদারের উপ-ঠিকাদার হিসেবে কেএলএমসি সম্পাদন করবে। কেএলএমসির সঙ্গে সিসিসিএল-বিসিআইসির দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি রয়েছে। বিধায় তারা রোপওয়ে মেরামত কাজের জন্য সিসিসিএলের সঙ্গে চুক্তি করতে চায়। সিসিসিএল ছাড়া অন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে চুক্তি করতে পারবে না বলে তারা জানায়। চুক্তি সম্পাদিত হলে শিগগির কাজটি শুরু করা যাবে বলে কেএলএমসি আশ্বন্ত করেছে।
প্রকল্প পরিচালক আব্দুর রহমান বাদশা এসব ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, কেএলএমসির প্রস্তাব অনুযায়ী চুক্তি করতে হলে সাধারণ ঠিকাদারের সঙ্গে আলোচনা করে ভারতীয় রোপওয়ে স্থাপন কাজের জন্য প্রাক্কলিত মূল্যের সম পরিমাণ অর্থ সাধারণ ঠিকাদারের চুক্তি থেকে কর্তন করে সিসিসিএলের মাধ্যমে কেএলএমসির অনুকূলে এলসি স্থাপন করা যেতে পারে।
সাধারণ ঠিকাদার এ বিষয়ে একমত পোষণ করে এবং তাদের কাজের সুযোগ সংশোধন করে চুক্তি সংশোধন করতে হবে বলে নিশ্চিত করেন।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) জানান যে, চুক্তির কোনো অংশে পরিবর্তন করতে হলে অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের অনুমোদন গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সাধারণ ঠিকাদার অথবা রোপওয়ে কাজের জন্য সাধারণ ঠিকাদারের নিয়োগ করা উপ-ঠিকাদারের মাধ্যমে চুক্তি সম্পাদন করা যেতে পারে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা কেএলএমসি ও সাধারণ ঠিকাদারের সঙ্গে আলোচনা করে চুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার নির্দেশনা দেন এবং ভারত-বাংলাদেশ অংশের নতুন রোপওয়ে স্থাপন কাজ দ্রত সম্পন্ন করারও নির্দেশনা দেন।
আরও পড়ুন: শুধু রণাঙ্গণের যোদ্ধারাই হবেন ‘মুক্তিযোদ্ধা’, বাকিরা সহযোগী: উপদেষ্টা
সর্বশেষ প্রকল্পটির মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর যে প্রন্তাব তৈরি করেছে, সেখানে ৪৩ কিলোমিটার নতুন গ্যাসলাইন স্থাপনের জন্য ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। নতুন পাইপলাইন নির্মাণের কাজই শুরু হয়নি। সিলেটের জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমস লিমিটেড (জেজিটিডিএসএল) এত দিন ছাতক অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের মূল লাইন থেকে ছাতক সিমেন্ট কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করত। কিন্তু নতুন কারখানায় যে পরিমাণ গ্যাস লাগবে, তা এ লাইন থেকে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই কারখানাটি চালু করতে গ্যাস সরবরাহের জন্য আলাদা সংযোগ লাইন লাগবে। কিন্তু কারখানাটি স্থাপনে যে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, তাতে গ্যাসলাইন স্থাপনের বিষয়টি ছিল নয়।
সর্বশেষ প্রকল্পটির মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর যে প্রস্তাব তৈরি করেছে, সেখানে ৪৩ কিলোমিটার নতুন গ্যাসলাইন স্থাপনের জন্য ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। বিসিআইসি জানায়, প্রকল্পের উৎপাদন ক্ষমতা প্রতিদিন দেড় হাজার মেট্রিক টন, যা আগের উৎপাদন ক্ষমতার প্রায় তিন গুণ বেশী। নতুন পাইপলাইন স্থাপন, বর্তমান পাইপলাইন অপসারণ (প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে) এবং গ্যাস সংযোগ প্রদানের কাজটি জেজিটিডিএসএলের তত্ত্বাবধানে এবং তাদের তালিকাভুক্ত ঠিকাদারের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হয়। পাইপলাইন স্থাপনের কাজটি দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য জেজিটিডিএসএলকে চিঠি দেওয়া হয়েছে এবং সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।
এছাড়া কাজটি দ্রুত শুরু করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার জন্য গত ৭ জুলাই শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে পেট্রোবাংলায় চিঠি দেওয়া হয়। পেট্রোবাংলার অনুমোদন পেলে জেজিটিডিএসএল দ্রুত নতুন গ্যাসলাইন স্থাপনের কাজ শুরু করবে বলে জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, গ্যাস প্রাপ্তির নিশ্চয়তা পাওয়া গেলে শিগগির গ্যাসলাইন স্থাপনের কাজটি শুরু করা হবে। ‘দীর্ঘদিন কোনো যন্ত্রপাতি পড়ে থাকলে জং ধরাটা স্বাভাবিক। মূল কারখানার কাজ হয়ে গেছে। গ্যাসলাইন টানতে হবে, টাকাও পেয়েছি। কিন্তু গ্যাসের অনুমতি মিলছে না। যন্ত্রপাতি জং ধরা ঠেকাতে আমরা ১৫ দিন পর পর সচল রাখছি।’- বিসিআইসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) গাজী কামরুল হোসেন। যে কারণে আবার প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি প্রয়োজন।
বিসিআইসি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ অংশে রোপওয়ে স্থাপনের কাজটি যথাসময়ে সম্পন্ন হলেও ভারতীয় অংশে রোপওয়ে স্থাপনের কাজটি সম্পন্ন করতে কমপক্ষে এক বছর সময়ের প্রয়োজন। বর্ষার মৌসুম শুরু হলে অতি বৃষ্টি ও বন্যার জন্য কাজ করা সম্ভব হয় না। এছাড়া সিলেট থেকে কারখানা পর্যন্ত গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন স্থাপনের কাজটির অনুমোদন এখন পর্যন্ত পেট্রোবাংলা থেকে পাওয়া যায়নি। সার্বিক দিক বিবেচনায় প্রকল্পটি অনুমোদিত মেয়াদ অর্থাৎ ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হবে না। এজন্য প্রকল্পটির ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
আরও পড়ুন: টাকা দিলেই মিলত জন্ম সনদ, সুযোগ নিয়েছে রোহিঙ্গারাও